ডেস্ক নিউজঃ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষযাত্রার কফিনে আমি চাই না। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করিও।
হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম (এমপি)বরাবরে এমন একটি চিঠি লেখার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেন।
তার এই চিঠিতে লেখা ওসিয়ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা (গার্ড অবঅনার) ছাড়াই দাফন সম্পন্ন করা হয় তাঁকে।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের শেষ বিদায়ের সময় সেখানে বিউগলে বাজেনি বিদায়ের সুর। জানাজার পূর্ব মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের চৌকস দল গার্ড অব অনার জানাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেনের মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত করা হয়নি।
সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেন পিতৃ স্নেহে চিঠিতে যা লিখে গেছেন তার মূল কথা হচ্ছে, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সুপারিশে ছেলে নুর ইসলামের নো ওয়ার্ক নো পে ভিক্তিতে গাড়িচালক হিসাবে চাকরি হয়। সেই সুবাদে নুর ইসলাম সদর এসিল্যান্ডের গাড়ি চালাতেন। কর্মস্থলে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে সেখানে উপস্থিত এডিসি (রাজস্ব) কে বিষয়টি দেখতে বলেন। হুইপকে বিষয়টি আবগত করায় প্রশাসন থেকে প্রথমে নুর ইসলামকে তার বসবাসরত খাস পরিত্যক্ত বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসিল্যান্ড সদরের মিসেস নুর ইসলামকে বাথ রুম পরিষ্কার ও মাংস রান্না করতে বলেন। মাংস রান্না ঠিক না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো.জাকারিয়াকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জেলা প্রশাসকও ক্ষিপ্ত হয়ে যান। এ ছাড়াও নুর ইসলাম তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাফ চাওয়ার জন্য এসিল্যান্ডের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারেনি।চাকরি চলে যাওয়ায় তারা উপায় না পেয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু প্রশাসন সেটি চরম নেগেটিভ ভাবে নেয়। বর্তমানে তার ছেলেটি চাকরিচ্যুত ও বাস্তচ্যুত হয়ে পরিবার নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তিনি আরো লিখেছেন, জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে নিয়ে করা স্বাধীন দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেওয়া হলো। গত ২১.১০.২০১৯ তারিখ থেকে এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতাল দিনাজপুরের কার্ডিওলজি বিভাগে, ওয়ার্ড নম্বর২, বেড নম্বর৪৪ এ ভর্তি অবস্থায় আছি, এই পত্রটি তোমার কাছে লিখছি। তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন তুমি ন্যায় বিচার কর। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেটিকে চাকরিচ্যুত করায় তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমার বয়স প্রায় ৮০ বছরের কাছাকাছি। ছেলেটি হঠাৎ করে চাকরিচ্যুত হওয়ায় একে তো আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ তারপর মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষযাত্রার কফিনে আমি চাই না।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২২ অক্টোবর চিঠিটিতে তিনি স্বাক্ষর করে ডাকযোগে ঢাকায় জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের বরাবরে প্রেরণ করেন। পরের দিন ২৩ অক্টোবর সকাল ১১টার সময় হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন আবস্থায় মারা যান।
বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর সকাল ১১টায় সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের যোগীবাড়ী গ্রামে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেনের জানাজা শুরুর পূর্ব মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ প্রশাসনের একটি চৌকসদল গার্ড অব অনার প্রদান করার জন্য যান। এ সময় স্ত্রী-ছেলে-মেয়েরা জানায়, তাদের পিতার জীবণ-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লিখে যাওয়া চিঠি অনুয়ায়ী তারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন বা গার্ড অব অনার প্রদান করতে দিবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তাদের ভাষায় এটাই হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মরহুম ইসমাইল হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
জানাজার আগে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেনের পরিবার-পরিজনের পক্ষে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মোফাজ্জল হোসেন দুলাল উপস্থিত সকলের উদ্দেশে বলেন, অন্যায়ভাবে মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেনের ছেলেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি এই চিঠি লিখে গেছেন। আমরা তার লিখে যাওয়া চিঠির ওসিয়ত অনুয়ায়ী দাফন করতে চাই। চিকিৎসার জন্য তিনি অনেকের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন।
গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে ছেলেরা বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় জেলা প্রশাসক বেতন পান। তিনি জেলার পিতা। তার সঙ্গে একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখা করতে গিয়ে দেখা পান না। এর চেয়ে লজ্জার কি হতে পারে। এই কারণেই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখান করেছেন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো.মাহমুদুল আলম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রশাসন থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে যাওয়ার পর বিষয়টি অবগত হই। তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করতে না দেওয়ায় তা প্রদান করা সম্ভব হয়নি।
মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো.ইসমাইল হোসেনের মুক্তিবার্তা নম্বর০৩০৮০১১০০২, ভাতা বই নম্বর৮১৯। ( প্রশাসন আর আমলাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যে অসৌজন্য আচরন তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসমাইল হোসেনের লিখে যাওয়া চিঠির প্রতিটি শব্দ, প্রশাসনের লোকজন প্রভাবশালী কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের সমীহ করলেও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে খুবই খারাপ আচরন করে, আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা এই বিষয় ব্যবস্থা নিবেন)
Get real time updates directly on you device, subscribe now.