মহান স্বাধীনতা দিবসে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ রহিম এর ধারণকৃত সাক্ষাৎকার
চেতনায় একাত্তর সম্পাদক: মুক্তিযুদ্ধে কেন গেলেন?
আঃ রহিম: পঁচিশে মার্চ কালো রাত্রে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানোয়ারের মতো ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুমন্ত মানুষদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরিহ লোকজনের নির্বিচারে হত্যা করে, এতে আমার মনে পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়, তাদের প্রতি আমাকে বিদ্রোহ করে তুলে এবং ৭ই র্মাচরে ঐতহিাসকি ভাষণরে আলোকে সেই রাত্রেই বি ডি আর ওয়্যারলসে মাধ্যমে বঙ্গববন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বিষয় উৎসাহিত করে।
চে.সঃ সেই কালো রাত্রে কোন শ্রেণীর লোকজন পাকিস্তানীদের হত্যার শিকার হয়?
আঃ রঃ রাস্তাঘাট রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস, ট্রেনসহ বিভিন্ন স্থানে অসহায় ছিন্নমূল, দরিদ্র মানুষজন গনহারে হত্যার শিকার হয়, তাছাড়া ঢাকা বিশ^ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ছাত্র শিক্ষকদের হত্যা করে পাশাপাশি তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা বিডিআর (ইপিআর) হামলা চালিয়ে অসংখ্য বাঙালি-পুলিশ ও বিডিআর সদস্যদের হত্যা করে, তবে আমাদের বাঙালি পুলিশ ও বিডিআর বাহিনী কাপুরুষের মতো হানাদারদের কাছে আতœসমর্পণ করেননি। তার প্রতিরোধ গড়ে তুলে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন।
চে.সঃ পঁচিশে মার্চ কালো রাত্রিতে আপনি কোথায় ছিলেন?
আঃ রঃ পচিঁশে মার্চ কালো রাত্রিতে ঢাকার পাশ^বর্তী মহকুমা বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলা নিজ পিতৃভূমি রিকাবী বাজারের দক্ষিন রামগোপালপুরে অবস্থান করছিলাম। গোলাগুলির শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠি, চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়, ঘর থেকে রাস্তায় নেমে আসি, আকাশে আলোর ঝলকানী। পরে রেডিও বিবিসি ও ভয়েজ অব আমেরিকা, কোলকাতা বেতার থেকে জানতে পারি পাকিস্তানীরা বাঙালিদের উপর অপারেশন সার্চ লাইট নামে বাঙালিদের উপর হামলা করছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে হানাদারদের হাত থেকে দেশ ও দেশবাসীকে মুক্ত করতে আহবান জানান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের। ভোর থেকেই ঢাকা ও আশপাশ শহর থেকে হাজার হাজার লোক আমাদের এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আসতে থাকে।
চে.সঃ মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগে আপনি দেশের জন্য কি করেছিলেন?
আঃ রঃ আমি তখন হরগঙ্গা কলেজের কলা বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। তখন আমরা আদারিয়াতলা ঈদগা মাঠে এড.ইলিয়াসের নেতৃত্বে বাঁশের লাঠি ট্রেনিং দিয়েছিলাম। যা বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে আমাদের উৎসাহিত করে। সিপাহীপাড়া আঃ গফুর এর নেতৃত্বে আইয়ুব ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে মিছিল করি, শ্লোগান ছিল আইয়ুব ইয়াহিয়া দুই শালা এক দড়িতে ফাঁসি লাগা। নানা ধরনের তৎপরতায় অংশ নেই। রকিাবি বাজার সাবকে এমএনএ আব্দুল করমি বপোরীর নতেৃত্বে সংগ্রাম পরষিদে হোসনে মব্বোর, কামাল উদ্দনি আহাম্মদে, শখে কুতুবউদ্দনি, খোন্দকার মলিন, সাহাবুদ্দনি প্রমুখদরে সাথে কাজ কর।ি
চে.সঃ কোন দিন মুক্তিযুদ্ধে যান?
আঃ রঃ একাত্তরের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কাটপট্টি লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চযোগে প্রথম রামচন্দ্রপুর যাই, সেইখানে সাতখানা গেিয় আলুভর্তা ডাল ভাত খাই। সেখান থেকে রাত দুইটার সময় চাবিতলা নামক গ্রামের এক বাড়িতে উঠি। সেভাবে খুবই ক্ষুধার্থ অবস্থায় বাড়ির মধ্যবয়সী এক মহিলা গভীর রাতে খেশারীর ডাল দিয়ে ভাত দেয়, আমরা খুবই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে পুনরায় ভোর রাতে রওয়ানা হয়ে সকালে কোনাবন বর্ডারে যাই, ভারতী সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকে এসেছি বললে তারা আমাদের ছেড়ে দেয় এবং জিপগাড়ি যোগে আমরা আগরতলা এসে কংগ্রেস ভবনে আশ্রয় নেই। কংগ্রেস ভবনে আঃ লীগ নেতা ডাঃ কাদির এর সাথে দেখা হয় ৪ দিন পর ডাঃ কাদির আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে। এড. দেওয়ান আবুল আব্বাস সাহেবকে আমাদের ট্রেনিং এ পাঠানোর নির্দেশ দেন, তখন দেওয়ান সাহেব বাস যোগে নরসিংঘর ক্যাম্পে নিয়ে যান, আমাদের মাধ্যমেই ক্যাম্প উদ্ধোধন হয়। ট্রেনিং চলা অবস্থায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরাগান্ধীর সাথে থাকা মন্ত্রী জয় প্রকাশ ক্যাম্প ভিজিটে এসে আমাদের সাথে মতবিনিময় করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহিত করে।
চে.সঃ আপনাদের সাথে কতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল?
আঃরঃ আমরা ৮ জন একসাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করি। তাদের মধ্যে অন্যতম আমি আঃ রহিম নিজগ্রামের মুক্তারপুর আদারিতলার খালেক ও রিকাবী বাজার পূর্বপাড়ার খালেক ভারতে গিয়ে আমাদের সংখ্যা হয় বার জন, তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের ৮ জন ছিল তাদের নাম জানা নেই।
চেঃসঃ ট্রেনিং শেষে কিভাবে দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন?
আঃরঃ এক মাস পি.টি ট্রেনিং পর ৬০০ জন থেকে বাছাই করে ১৪০ জনকে সিলেক্ট করে এই ১৪০ জনকে একটি গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত এক পাহাড়ের চুড়ায় নিয়ে যায়। উক্ত পথ অতিক্রম করেত সারাদিন লেগে যায়। গভীর বনজঙ্গল পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে যেতে হয় রাতে শিখ সেনারা আমাদের রিসিভ করে পরে জানতে পানি উক্ত স্থানটি আসমাম চেরাপুঞ্জী এলাকা। সেখানে কিছুটা উন্নত ধরণের থাকা ও খাওযার ব্যবস্থা করা হয়। এক রাজপুত্র মেজরের অধীনে আমাদের ৪টি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। আমি ডি-গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত হই, ডি-গ্রুপের নাম হয় ডালডা ত্রুপ। ৪ দিন পর টেনিং শুরু হয়। থ্রি নট থ্রি রাইফলে দিয়ে ট্রেনিং শুরু করে। স্টেনগান,মেশিনগান, এস.এল.আর, দুই ইঞ্চি ও থ্রি ইঞ্চি মর্টান গান, নাইটি ডিগ্রী এনারগা এমব্রোস কাটিং চার্জ সামনা-সামনি মল-যুদ্ধের কৌশল, ব্রীজ, দালান, রেলগাড়ি ইত্যাদি কাটিং চার্জসহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাছাড়াযুদ্ধে গোপনীয় কৌশল ও গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধে কলাকৌশল থিউরীক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সেখানে ১৩০ টাকা ভাতা দেওয়া হয় এবং নতুন শার্ট দেওয়া হয়। সেখানে একমাস উন্নতমানের ট্রেনিং শেষে আমাদের পুনরায় মেজর হায়দার সাহেবের অধীনে মেলাঘর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে ৭ দিন পর আচমকা আমাদের গাড়িতে তুলে সোনামোড়া ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সোনামোড়া ক্যাম্পের দায়িত্ব দিলে বিগ্রেডিয়ার মোশারফ উক্ত ক্যাম্প পাকিস্তানীদের মর্টার সেলের আঘাতে বিধ্বস্থ হয়। প্রচুর ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধা হতা-হত হয়। আমাদের দিয়ে হতাহত মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়িতে উঠানোর হয় এবং অন্যত্র পাঠানো হয়। পুনরায় উক্ত ক্যাম্প থেকে আমাদের গভীর জঙ্গলে নেওয়া হয়, সেখানে আমরা তাবু স্থাপন করি। এলাকাটি গুর্খাল্যান্ড হবে। উক্ত ক্যাম্পে আহতদের চিকিৎসার জন্য আনা হয়। খালেদ মোশাররফও আমাদের সাথে ক্যাম্পে আসে, সেইখানে রোগীদের পরিচর্যা করে ডা. এর অধীনে রাখা হয় এবং আমাদের পুনরায় মেলাঘরে নিয়ে আসা হয়। খালেদ মোশারফ উক্ত ক্যাম্পে থেকে যান।
সেই খানে সাত দিন পর কাজী আনোয়ার ও মোঃ ফজলুল হক বিহার থেকে ট্রেনিং শেষে মেঘালয় নিয়ে আসা হয়। উক্ত ক্যাম্পে আমাদের মুন্সিগঞ্জের তিনজন একসাথে হই। ১৫ দিন পর মেজর হায়দার আমাদের নিয়ে বৈঠক করে, সাথে ঢাকার আঃ আজিজ, লাকী, সিরাজদিখান বাচ্চু, লতিফ, আড়িয়লের বাবুল মোট চৌদ্দজন বৈঠকে ছিলাম। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি এস.এল. আর, একটি স্টেনগান, প্রচুর এক্সপুলোমিন, ডেটোনেটর, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ আমাদের চৌদ্দ জনকে ট্রাকে করে মনতলা ৫৬ যুদ্ধ ফিন্ডে নিয়ে আসা হয়। বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তখন অফিসিয়ালী আমাদের গ্রহণ করেন।
রাত ২.৩০ মিনিটে আমাদের লাইনে দাড় করিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে একজন বাঙালি গাইড মারফত আমাদের সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দিয়ে বিদেয় দেয়। খালেদ মোশাররফ তখন শেষ বারের মতো বলেন, যাও বাবা দেশের জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে দেশের মানুষকে রক্ষা কর, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। কয়েক মাইল হেঁটে এসে নৌকা দিয়ে সিএমবি ব্রীজের তলদিয়ে আমরা রামকৃষ্ণপুর পৌঁছে সেখানে নৌকা বদল করে মেঘনার খালিয়াচর গ্রামে উঠি, অল্প সময় বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে অন্য নৌকায় মুন্সিগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ চরে এসে সকাল ৮ টায় এক কৃষক বাড়িতে উঠি। সেখানে আমাদের অস্ত্র-সস্ত্র দেখে মহিলা ভয় পেলে তাদের পরিচয় দেই। তখন তারা আমাদের নানা ধরণের সহযোগিতা করে। পরবর্তীতে মোস্তাক আহমেদ নামক এক লোক রাত ৮ টার দিকে নিয়ে যায় চর মগুরার হারেজ মিয়ার বাড়িতে, সেখানে এক সপ্তাহ অবস্থান করে গ্রিণ সিগন্যাল পাওয়ার পর এবং রাজাকারের অত্যাচার অতিষ্ট গ্রামবাসীকে রক্ষা করতে আমাদের নিয়ে আসা হয় সদর থানার মহাখালী গ্রামে আনন্দ দাসের বাড়িতে। সেখানে সুলতান বেপারী আমাদের নানা রকম সহযোগিতা করে। পরে পাক আর্মিদের আগমনের খবর এবং রাজারদের অত্যাচারে গ্রামবাসী আমাদের অন্যত্র চলে যেতে অনুরোধ করে। কান্নাকাটি করে, কোন বাড়ির লোকেরাই আমাদের আশ্রয় দিতে রাজী না হওয়ায় আমরা নিরিহ গ্রামবাসীদের রক্ষার্থে চাপাতলী খালসহ বিভিন্ন নদীতে নৌকাযোগে অবস্থান নিয়ে রাজাকারদের উপর লক্ষ্য রাখি। সেই সময় অনেক নিরিহ গ্রামবাসী নৌকায় আমাদের খাবার সরবরাহ করে। বিশেষ করে রাতে রতনপুর ব্রীজে আসলে বাগাবাড়ির আনোয়ার আলী দেওয়ান জজকোর্টের পেশকার রতনপুর ব্রীজের নিচে নৌকায় ভাত, ডাল, মাছ দিলে তা খেয়ে আমরা বেঁচে থাকতাম।
এখানে একটি বিষয় মেলাঘর ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় আঃ লীগ নেতা কফিলউদ্দিন চৌধুরী আমাদের মাধ্যমে তার ছেলেকে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যে যে সংবাদ পাঠিয়েছিল তার ছেলে বি.চৌধুরীকে তার বাড়িতে নৌকা যোগে গিয়ে সেই খবর দেই, কফিলউদ্দিন চৌধুরী ভারতে মেজর হায়দার এর অধীনে ভাল আছে। কোন চিন্তা করিওনা। তোমরা সাবধানে থেকো এবং তৎকালিন এমপি করিম বেপারীকে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বলে। সেই খরবও পৌছে দেই এবং আর বলে, করিম আমার পাশে ছিল আমি বর্ডায় ক্রস করে ভারতে প্রবেশ করি। কিন্তু করিম কোথায় যেন হারিয়ে গেল, তার জন্য চিন্তায় আছি তাকে জানাবে।
সংবাদ পেয়ে খুশী হয়ে বি চৌধুরী আমাদের দশটি টাকা দেয় এবং নাস্তা করায়। এভাবে অক্টোবর মাস পর্যন্ত নৌকায় থেকে অপারেশন করি। পরবর্তীতে নভেম্বরের প্রথম দিকে দিকে আলদীর বাচ্চু কাজীর বাড়ি, তারপরে আঃ আউয়াল তালুকদার এর বাড়ি, কিছুদিন পর মহাখালীর আফসারউদ্দিন ঢালী চেয়ারম্যানের বাড়িতে এবং বেপারী বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করি।
এখানে উল্লেখ্য বি.চৌধুরী তার চাচাতো ভাই জামাল চৌধুরীকে আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে পাঠায়। পানাম মোল্লাবাড়ি মালিপাথর পন্ডিত মাদবরের বাড়িও ক্যাম্প ছিল। হাটকান তোফাজ্জল বেপারী বাড়ি, চুড়াইন মতিন সাহেবের বাড়ি, দালাল পাড়া শফিউল হক এর বাড়ি হয়ে সিপাহীপাড়া ড. আবু বকররে বাড়িতে সেখান থেকে ড. মজিবুর মোল্লার বাড়ি চাপাতলী দত্ত বাড়ি হয়ে সর্বশেষ পঞ্চসার বিনোদপুর হাইস্কুলে ক্যাস্প স্থাপন করি এবং এবং পঞ্চসার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অস্ত্র জমা দেই। এভাবে বিভিন্ন ক্যাম্প পরিবর্তন করে রাজাকার ও পাকিস্তানী দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং অপারেশন করি।
চে.সঃ আপনাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব কিভাবে পরিচালিত হত?
আঃরঃ পূর্বেই বলেছি আমরা দুই নম্বর সেক্টর অধীন মুন্সিগঞ্জ জেলায় খালেদ মোশাররফ, পরবর্তীতে মেজর হায়দারের অধীনে যুদ্ধ করি। আমাদের জেলা অধিনায়ক ছিল মোঃ আবু হানিফ তিন থানায় তিন থানা কমান্ডার ছিল মোজাজ্জল হক, গ্রুপ কমান্ডার হিসাবে আমি আঃ রহিম যুদ্ধ করেছি এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) হিসাবে।
চে.সঃ আপনাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব কিভাবে পরিচালিত হত?
আঃরঃ পূর্বেই বলেছি আমরা দুই নম্বর সেক্টর অধীন মুন্সিগঞ্জ জেলায় খালেদ মোশাররফ, পরবর্তীতে মেজর হায়দারের অধীনে যুদ্ধ অংশ নেই, তাছাড়া বহু রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজনকে হত্যা করি। তবে যারা নিরহ লোকদের উপর অত্যাচার করেনি, বা প্রমাণিত হয়নি তাদের ছেড়ে দেই।
চে.সঃ জেলায় প্রথম অপারেশনের বিষয়ে কিছু বলবেন কি? বা গুনছেন কি?
আঃরঃ শুনেছি – জেলার প্রথম অপারেশন হয় মুন্সীগঞ্জ শহরে পাকসেনাদের ক্যাম্পের পাশে পুরনো কাচারীর উকিল লাইব্রেরীতে। সেখানে অবস্থানরত পাকহানাদার দালালদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম আক্রমণ করে দুইজন দালালকে হত্যা করে কয়েকজন আহত হয়। এতে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনবার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে এবং দালালরা চুপসে যায়। এতে করে সাধারণ জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
চে.সঃ আপনার সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছে কি?
আ.রঃ আমাদের সহযোদ্ধা শহীদ হয়নি তবে পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে শুরুতর আহত হয়েছে তাদের মধ্যে সাত্তার মোল্লা অন্যতম।
চে.সঃ স্বাধীনতা অর্জনে আপনাদের ত্যাগ তিতিক্ষা অবদান স্বার্থক হয়েছে কি?
আ.রঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলাদেশ নামক একটি দেশ পেয়েছি, আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয়নি। এখনও মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মামলা মোকদ্দমা, চাকরি-বাকরী বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাধীনতা বিরোধীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সকলেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধাদের কথা বলে ক্ষমতায় আসে আবার ক্ষমতায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভুলে যায়। রাজাকার স্বাধীরতা বিরোধীদের উন্নয়ন করা হয়। কেন আজ মুক্তিযোদ্ধা ৫০০০/- টাকা ভাতা পাবে না, কে সরকারীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানতি নাগরিক এর সকল প্রকার ভিআইপি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না। আজ মুক্তিযোদ্দা সন্তানদের কোঠা বাতিলের চক্রান্ত চলছে। যারা দেশ চালাচ্ছে সরকারী আমলা কর্মকর্তা সুধীসমাজ বিভিন্ন বিদগণ তাদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানী পদ-পদবী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন যোগায়নি, বরং তারা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে মুক্তিযুদ্ধেও বিরোধিতা করেছে। তারাই আজ সরকারী কর্মচারী সাদাত হোসেন, সফি সামী, ম.খ.আলমঙ্গীর, মোফাজ্জল করিম, এম মজিবুল হক, মোজাফফর আহম্মেদ, ইনাম আহমেদ, মোকাম্মেল হক, মনজুর এ মাওলা, ফরাসউদ্দিন, মার্গুব মোর্শেদ, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, ওবায়দুল হক, শেখ আতাউর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, জুলমত আলী, রাজিয়া ফয়েজ, বিচারপতি নুরুল ইসলাম, এ.কে.এম ফয়জুল হক, মোশাররফ হোসেন, সারজাহান প্রমুখ ঘৃণিত ব্যক্তিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করা পরও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়। তাদের দ্বারা মুক্তিযোদ্ধাদের চরিত্র হরণ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আজ বঙ্গভবনে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের বিধবা স্ত্রী, সন্তানদের জন্য ক্ষুধা নিবারণে জুটা খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এতে বুঝা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে মর্যাদা করা হয় এবং মূল্যায়ণ কতটুকু তারা আর্থিকভাবে কতটা অসহায়, জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জারোধ থাকা উচিত। লজ্জায় আতœহত্যা করা উচিৎ মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী খানের চোখের জল আমার অন্তর ভিজে গেছে।
তাই কিছু লোকের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দূরে থাক নূন ভাতেরও সংস্থান হয়নি।
চে.সাঃ আপনি কি দেশের বিষয় আশাবাদী?
আঃরঃ অবশ্যই আমি দেশের উন্নয়নে সাধারণ মানুষের ভাগ্যউন্নয়নে আশাবাদী। কারণ, যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের আসনে স্থান দিতে হবে, দেশের দরিদ্র জনগণের পেটের ভাতের ব্যবস্থা করতে হবে। নচেৎ দেশ উল্টো পথে হাটবে এবং এর দায় দায়িত্ব ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন, ছিলেন সকলকেই বহন করতে হবে।
চে.সঃ আপনার স্বপ্ন কি?
মুক্তিযুদ্ধের আলোকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই দেশের দরিদ্র দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুর ডাক ছিল সাংবিধানিকতার আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপদান, অপশাসন ক্ষমতার দলখদারিত্ব গণতন্ত্রকে হত্যার বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন তাই বঙ্গবন্ধুর নীতিতে দেশ পরিচালিত হবে বলে আমি আশাবাদী, স্বপ্ন দেখি।
চে,এঃ সঃ আপনাকে চেতনায় একাত্তরের পক্ষে ধন্যবাদ।
আঃরঃ আপনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ওমর আলীর গ্রুপে ছলিনে , আপনাকে ধন্যবাদ জানাই, সাথে সাথে চেতনায় একাত্তরের সফলতা কামনা করি।
(২০০৮ সালের ১লা মে চেতনায় একাত্তর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাতকারটি মহান স্বাধীনতা দবিসে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল রহিমের স্মরণে হুবুহু প্রকাশ করা হল, সাক্ষাৎকারটি গ্রহন করনে বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহম্মেদ, সম্পাদক, চেতনায় একাত্তর )